আমার কথা/ অক্টোবর ২০২২

পটচিত্রের কোজাগরী লক্ষীপূজা

অরুন্ধতী ঘোষ

সেদিন এক লক্ষীপূজায় গিয়ে দেখি মা লক্ষী সরায় (পটচিত্রে লক্ষী) অবস্থিত। বড় ভালো লেগেছিল এই মাটির সরায় আঁকা দুই সখী জয়া ও বিজয়াকে নিয়ে পূজিতা মা লক্ষীকে। আমি বড় হয়েছি মা লক্ষীর ছবি বা মূর্তি পূজা দেখে। আমার ঠাকুর্দার বাড়িতে  বেনারসী শাড়িতে  মোড়া ধানভর্তি পিতলের ঘড়া পূজা হত। সামনে দেওয়া হত অনেক রকমের আল্পনা (ধানের ছড়া, পেঁচা, মায়ের পায়ের ছাপ ইত্যাদি)। মামার বাড়িতে পূজা এখনো হয় লক্ষী ঠাকুর গড়ে, জয়া ও বিজয়াকে নিয়ে।

কোজাগরী লক্ষীপূজা হয় শারদ পূর্ণিমায় (বাংলার কোজাগরী পূর্ণিমা)। এদিনে পশ্চিমবংগ ও বাংলাদেশে হিন্দুদের ঘরে ঘরে লক্ষীপূজা হয়। বিভিন্ন অঞ্চলের, বিভিন্ন পরিবারের লক্ষীপূজা পদ্ধতী, ধরণ, নয়মাবলী নিজস্ব। এই দিনে মা লক্ষী পূজিত হন ভিন্ন ভিন্ন আকারে, যেমন মূর্তি, ছবি, ধান ভর্তি ঘড়া, পঞ্চপ্ত্রিকা, নবপত্রিকা, সরায় আঁকা পটচিত্রে। এবারে সরা পূজা নিয়ে কিছু বলব।

ছবি ১) কোজাগরী লক্ষী পূজা

লক্ষীর পটচিত্র বা সরায় আঁকা ছবি- সরা হল থালার থেকে একটু ছোটো, অল্প কানাত উঁচু একটি টেরাকোটা (পোড়ানো মাটি) পাত্র, যার বাইরের দিকটি উত্তল (convex) ও ভিতরের দিকটি অবতল (concave)। সরা মূলতঃ ব্যাবহৃত হয় মাটির হাড়ি ও কলসীর ঢাকনা হিসেবে। কুমোররা প্রথমে মাটির সরা বানিয়ে আগুনে পুড়িয়ে নেন। তারপর বাইরের উত্তল দিকটি মসৃণ করে চারিপাশে লাল রঙের বর্ডার করে মধ্যস্থানে সাদা বা হলুদ রঙ করে তারপর প্রতিমা আঁকেন। ছবি থেকে  আঁকার পর এক বিশেষ ধরণের আঠার (সাবুদানা বা তেঁতুলের বিচির গুড়ো থেকে তৈরী) প্রলেপ দেওয়া হয় যাতে রঙ ধুয়ে না যায়। এরপর পালিশ করে উজ্জল্য বাড়ানো হয়। এভাবে তৈরী হয় পটচিত্র।পূজা ছাড়াও গৃহশোভা বাড়ানোর জন্য পটচিত্র ব্যাবহৃত হয়। সরাপূজা দেখা যায় ওপার বাংলায় (পূর্ববংগ) ফরিদপুর, ঢাকা, কুমিল্লা, বরিশালের হিন্দু পরিবারে। পশ্চিমবঙ্গে এই সরাপূজা আসে এক বিশেষ কুমোর সম্প্রদায়ের সঙ্গে দেশভাগের সঙ্গে। এখনো নৈহাটি, সোদপুর, পাণিহাটি, হাওড়া ইত্যাদি অঞ্চলে সরাপূজার প্রচলন আছে।

চার ধরণের পটচিত্র দেখতে পাওয়া যায়। ১) সুরেশ্বরী সরা- ফরিদপুর জেলার মাদারিপুর অঞ্চলে। এখানে পটচিত্রের জন্ম হয়। পটচিত্র তিনটি প্যানেল, মাঝখানে মা দূর্গা সপরিবারে, উপরে শিবঠাকুর ও নীচে মা লক্ষী। ২) গনকী সরা মানে আগেকার দিনে গনকঠাকুরের (গনৎকার) বানানো পটচিত্র। আগে বাংলার প্রায় প্রত্যেক গ্রামে একজন করে গনকঠাকুর থাকতেন যাদের কাজ ছিল গ্রামের মানুষের ঠিকুজি-কুষ্ঠী তৈরী করা ও প্রতিমা রঙ করা। গনকী সরার রঙ লাল, দুটি প্যানেল থাকে। ওপরে সপরিবারে মা দূর্গা অস্ত্র-সস্ত্র নিয়ে, নীচে মা লক্ষী। এই সরা এখন প্রায় লুপ্ত। ৩) ফরিদপুরী সরা- এটির দুটি প্যানেলের মধ্যে ওপরে দেবী দূর্গা বা লক্ষী-নারায়ণ বা রাধা-কৃষ্ণ, নীচে মা লক্ষী। ৪) ঢাকাই সরা- এখানে মা লক্ষী ময়ূরপঙ্খী নোকায় বসে আছেন।

ছবি ২) মা লক্ষী পটচিত্রে

এই গেল প্রধান চার রকমের সরার কথা।  লক্ষী সরা ও দূর্গা সরা ব্যাবহৃত হয় শাক্ত পরিবারে। রাধা-কৃষ্ণ সরা ব্যাবহৃত হয় বৈষ্ণব পরিবারে। এছাড়া মহরমের সময়ে বিভিন্ন মুসলীম পরিবারে মহরম সরা ব্যবহৃত হয়।

আগেই বলেছি পূজা ছাড়াও পটচিত্র ব্যাবহৃত হয় গৃহসজ্জায়। দেওয়ালে টাঙানো রঙ্গিন পটচিত্র আমাদের গ্রামবাংলার বিশেষ শিল্পশৈলীর পরিচয় দেয় এবং  ঐতিহ্য বহন করে। এখনো কলকাতায় হস্তশিল্পের মেলায় কিছু পটচিত্র দেখা যায়। তবে নগরকেন্দ্রিক জীবণে অভ্যস্ত মানুষ আস্তে আস্তে এইসব শিল্পকলার কথা ভুলে যেতে বসেছে। তাই অনেকদিন পর এই প্টচিত্র পূজিত হতে দেখে ভীষণ ভালো লাগল।

ছবিঃ সুবর্ণা ঠাকুর ও ঋতুপর্ণা তা

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান