
ওলো সই ওলো সই,
আমার ইচ্ছা করে তোদের মতন মনের কথা কই।
ছড়িয়ে দিয়ে পা দুখানি, কোনে বসে কানাকানি
কভু হেসে কভু কেঁদে, চেয়ে বসে রই|
বোষ্টনের নিকটবর্তী মনরো সেন্টার ফর আর্টস (Monroe Center for Arts) -এ একটি অনুষ্ঠান চলছে। বিষয় “Women & Gender in Tagore’s Songs”। অনেক শ্রোতা, বেশীরভাগই বিদেশি। একজন মহিলা আলোচনা করছেন রবি ঠাকুরের “ওলো সই ওলো সই” গান টি। রবীন্দ্রনাথ গানটি রচনা করেছিলেন তার স্ত্রী ও ভাইঝিকে দেখে। একদিন তিনি দূরে বসে আছেন, দেখছেন তারা নিজের মনে গল্প করছেন, আর মাঝে মাঝে হাসতে হাসতে একে ওপরের গায়ে ঢলে পড়ছেন। তারা কি নিয়ে আলোচনা করছে, তিনি জানেন না, তিনি তাদের দুর থেকে দেখছিলেন, এর থেকেই এই গানটির সৃষ্টি।এবার “সই” কথাটির মানে বোঝাতে গিয়ে তার মনে হল কি করে বোঝাবেন? “সই” কথাটির কোনো ট্রান্সলেশন হয় না ইংরেজিতে। এটা শুধু মেয়েদের এক বিশেষ বন্ধুত্ব, কিন্তু বন্ধুত্বের থেকে অনেক গভীর এক প্রতিশ্রতি, যেটা আমাদের বাংলা ভাষাতেই আছে। তাই তিনি “সই” নামটা বাংলায় বলে, ইংরেজিতেই বাকিটা বোঝালেন।শ্রোতাদের খুব ভালো লাগল।পরেও দু-তিনজন তার কাছে এসে বলেছেন যে তারা সই হতে চান। ইন্সটাগ্রামে “সই” খুব জনপ্রিয়তা পেল।
সেদিনের সেই মহিলা যিনি “ওলো সই” রবি ঠাকুরের এই গান টি তার আমেরিকান শ্রোতাদের বোঝাচ্ছিলেন, তিনি হলেন মৈত্রেয়ী চক্রবর্তী, রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী, শিক্ষিকা এবং যাঁর একমাত্র জীবণে লক্ষ্য রবীন্দ্রনাথকে আরো বৃহত্তর জনগনের কাছে পৌছে দেওয়া, বাংলা যাদের মাতৃভাষা নয়। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে অনেকেই রিসার্চ করেন, তাঁকে নিয়ে লেখেন।কিন্তু মৈত্রেয়ীর রবীন্দ্রনাথ-চর্চা একটু অন্যরকমের।তিনিও রবীন্দ্রনাথের গান মানুষের কাছে পৌঁছে দেন তার কল্পনার রঙের তুলিতে রবিঠাকুরের গানের ছবি এঁকে, কখনো গানের সৃষ্টির মুহূর্তটি প্রাঞ্জল বর্ণণার মাধ্যমে, কখনো বা নিজের জীবণের অভিজ্ঞতার মাধ্যমে।মৈত্রেয়ীর পরিচয় শুধু সীমাবদ্ধ নয় গীতশিল্পী বা শিক্ষিকা হিসেবে। তিনি তার পরিচিতি আরো এক ধাপ বাড়িয়েছেন রবীন্দ্র-সচেতনতা এদেশের মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়ে। তার সুন্দর গান, অভিনব বাচন-ভঙ্গী মানুষকে টানে তার সেমিনারে, তার অনুষ্ঠানে। এই গুণী মানুষটি এবারে আমার সহচরী।

মৈত্রেয়ীর ছোটবেলা কেটেছে যাদবপুরে, পৈতৃক বাড়িতে। মা, বাবা, ছোটপিসি ও তারা দুই বোন। শৈশবে ছোটপিসিকে খুব ভালবাসতেন, সারাক্ষণ তার সঙ্গে সঙ্গে থাকতেন।। পিসি গীতবিতানে গান শিখতেন এবং বাড়িতে যখনি হারমোনিয়ামে রেওয়াজ করতে বসতেন, ছোট্ট মৈত্রেয়ী হারমোনিয়েমের ওপরে চেপে বসতেন। পিসির কোলে বসে বায়না করতেন “প্রভাতে বিমল আনন্দে”গানটি শোনার জন্য আর না গাইলেই রেগে যেতেন ভীষণ। বাড়িতে মা ও বাবা দুজনে গান জানতেন এবং বাড়িতে ভালোই গানের পরিবেশ ছিল। একটু বড় হয়ে ভর্তি হলেন শ্রী সুবিদ ঠাকুরের কাছে গান শিখতে। ইনি ঠাকুর পরিবারের সদস্য। তখন মৈত্রেয়ী কারমেল কনভেন্ট-এ পড়েন এবং এখান থেকেই স্কুলজীবণ শেষ করেছিলেন। পড়ার সাথে সাথে মা তাকে সি এল টিতে (Children’s little theater)।অনেক কিছু শিখেছেন সি এল টি তে, প্রায় ১০ বছর নাচ শিখেছেন এখানে। সি এল টি এমন একটি প্রতিষ্ঠান যাতে একটি বাচ্ছাকে সবরকম নাচের ট্রেনিং দেওয়া হয়- কত্থক, ওড়িসি, ভারতনাট্যম ও কথাকলি। ট্রেনে করে দলের সঙ্গে বিভিন্ন শহরে প্রোগ্রাম করতে গেছেন সি এল টি থেকে। তার মনে পড়ে দিল্লিতে তাদের প্রোগ্রামের পর ইন্দিরা গান্ধী তাদের ব্যাংকোয়েট হলে তাদের আমন্ত্রণ করেছিলেন। জিজো, সাক্ষীগোপাল ইত্যাদি ড্যান্স-ড্রামায় প্রধান ভুমিকায় নাচ করেন। নাচের সঙ্গে সঙ্গে গানের চর্চাও চলেছে পাশাপাশি।ক্লাস ফাইভে পড়াকালীন বেঙ্গল মিউসিক কলেজে সঙ্গীত প্রভাকর ও গীতপ্রভা (মিক্সড্ বাঙ্গলা গান) ডিগ্রী নিয়ে নেন। স্কুলের সাংস্কৃতিক প্রোগ্রামে অনেক অংশগ্রহন করেছেন। একবার এরকম একটি স্কুলের বার্ষিক অনুষ্ঠান। শ্যামা হবে। শ্যামার গান গাইবে একটি ক্লাস টেনের মেয়ে, কিন্তু অনুষ্ঠানের ৫ দিন আগে জানা গেল যে শ্যামা করবে, সেই মেয়েটির চিকেন পক্স হয়েছে। মৈত্রেয়ীকে শ্যামার গানে বসানো হল। একটি ছোট মেয়ের গলায় শ্যামার গান শুনে সবাই অবাক। সবার চোখে তিনি পালটে গেলেন। এরপর রাজ্যব্যাপী রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রতিযোগিতায় পরপর তিন বছর প্রথম স্থান পেয়েছেন। প্রয়াত শ্রী সুবিনয় রায়ের হাত থেকে পুরস্কার পেয়েছেন। এছাড়াও কলেজে পড়াকালীন কলকাতা “ক” এবং যুববানীতে গান গাইতেন নিয়মিত। প্রয়াত শিল্পী শ্রীমতি কৃষ্ণা চট্টোপাধ্যায়ের কাছে অতুলপ্রসাদ, রজনীকান্ত ও দিজেন্দ্রগীতি শিখেছেন। স্কুলের গন্ডী ছাড়িয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংলিসে ওনার্স নিয়ে বি এ পড়তে ঢুকলেন। বি এ পরীক্ষার দুমাস আগে বিয়ে হয়ে গেল ইঞ্জিনীয়ার দেবব্রত চক্রবর্ত্তীর সঙ্গে।

বিয়ের পর পরীক্ষা দিয়ে মৈত্রেয়ী চলে এলেন স্বামীর কাছে ট্যুসন, অ্যারিজনাতে। এখানকার ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনে নাচের প্রোগ্রাম করলেন। কিছু স্টুডেন্ট হলো।ছয়মাসের মধ্যে চলে এলেন লস এঞ্জেল্সে স্বামীর কর্মসুত্রে। বড় শহর। গান-বাজনার একটা জগত পেলেন। স্থানীয় ভারতীয় সমিতি থেকে গান গাইতে ডাকতো বিভিন্ন অনুষ্ঠানে। ছেলেবেলা থেকেই ভালোবাসা রবীন্দ্রসঙ্গীত। সেটাতেই মনপ্রাণ ঢেলে দিলেন। মাঝে মাঝেই গান ট্রানস্লেট করতেন। একবার ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া আরভিন (U. C. Irvine) থেকে একজন অধ্যাপক তাকে রবীন্দ্রনাথ নিয়ে একটি সেমিনার দিতে বললেন। তার সঙ্গে ছিলেন প্রখ্যাত সরোদবাদক শ্রী আলম খান। তারপর অন্যান্য কলেজ ও ইউনিভার্সিটি থেকে ডাকতে লাগল তাকে রবিঠাকুর ও তাঁর গান নিয়ে কথা বলার জন্য। মৈত্রেয়ীর নিজের কথায়, “রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর দর্শনের একটা স্বাদ যদি বিদেশী লোকজনের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া যায় তাহলে তাঁর গানের ইংরেজিতে অনুবাদ করতে হবে এবং মানুষকে বোঝাতে হবে।“ সেই কাজটি মৈত্রেয়ী শুরু করলেন। দীর্ঘ প্রবাসে তিনি অনেক জায়গায় গানের অনুষ্ঠান করেছেন। ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া লস এঞ্জেল্স, ক্লেয়ারমন্ট কলেজ, হোপ ইন লাইফ ফাউন্ডেশন (ফান্ড-রেসিং কনসার্ট), বাঙ্গলাদেশ কন্সুলেট ইন লস এঞ্জেল্স, বেদান্ত সোসাইটি অফ হিউস্টন, মন্মাউথ ইউনিভার্সিটি (নিউ জার্সি), ওয়েলেসলি কলেজ ইত্যাদি এদের মধ্যে উল্লেখ্য। এছাড়াও বেশ কয়েকবার বঙ্গসন্মেলন ও বঙ্গমেলাতেও অনুষ্ঠান করেছেন। এছাড়াও পশ্চিমবঙ্গ সরকারের চেম্বার অফ কমার্স -এর প্যালেডিয়াম লাউঞ্জে সঙ্গীতমেলায় সঙ্গীত অংশগ্রহণ করেছেন।
এদেশে এসে পোষ্ট-গ্রাজুয়েশন করেছেন এবং গানের পাশাপাশি মৈত্রেয়ী নর্থ হলিউড হাই স্কুলে শিক্ষকতা করেছেন, গ্লেনডেল কমিউনিটি কলেজে পড়িয়েছেন। বেশ কিছুদিন টেকনিক্যাল এডিটিং এর কাজ করেছেন বেশ কিছু মার্কেটিং কোম্পানির হয়ে।

২০১৬ তে স্বামীর কর্মসূত্রে চলে এলেন বোষ্টনে। এক্কেবারে পশ্চিম থেকে পূর্বে। বোষ্টনে এসে অনেক জায়গায় প্রোগ্রাম করেছেন। ধীরে ধীরে অনেক লোকের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে। এখানে তার ভালোবাসা রবীন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রচিন্তা-ভাবনা ও রবীন্দ্রদর্শন মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া প্রধান কাজ হয়ে দাঁড়াল।নিউটন পাব্লিক লাইব্রেরির পরিচালক এলেন মায়ার্স (Ellen Meyers, Director of Newton Public Library)-এর সহায়তায় লাইব্রেরীতে সাংস্কৃতিক প্রোগ্রাম করেছেন। ক্রমে ক্রমে মৈত্রেয়ী রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে “Online Program” শুরু করেন এবং বিভিন্ন সভায় ও সেমিনারে ডাক পেতে শুরু করলেন। ইতিমধ্যে এই বিষয়ে কাজ করার জন্য তিনি নিউটন কালচারাল কাউন্সিল থেকে অর্থ (Grant) পেয়েছেন।নিউটন ফেস্টিভ্যাল অফ আর্ট্স-এ দুবার গানের প্রোগ্রাম করেছেন। শহরের অনেক লাইব্রেরির অডিটোরিয়ামে প্রোগ্রাম করেছেন রাজ্যসরকারের (স্টেট গভর্নমেন্ট) থেকে পাওয়া ফান্ডিং-এর সাহায্য।। এদিকে বিভিন্ন লাইব্রেরীতে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে পরিচিতির পর তারাও রবীন্দ্রনাথের বই রাখতে শুরু করেছেন। এই জনসাধারণের জ্ঞান বাড়ানো রবি ঠাকুরকে নিয়ে- এটা একদিনে হয় নি। সম্ভব হয়েছে মৈত্রেয়ীর অফুরন্ত উৎসাহ, ভালোবাসা এবং উদ্দমের জন্য। এখন কিছু লোক মৈত্রেয়ীর সেমিনারে এসে বলে তারা টেগোর পড়েছে। এটাই মৈত্রেয়ীর সার্থকতা।
সম্প্রতি মৈত্রেয়ী লেক্সিংটনের ইউনিটারিয়ান চার্চে অনুষ্ঠান করেছেন দীপাবলি এবং হানুকার ওপরে। এছাড়াও কমন স্ট্রিট স্পিরিচুয়াল সেন্টারে পরিবেশন “Soul to Soul” নামক গানের অনুষ্ঠানটি।

মৈত্রেয়ীর প্রথম গানের সিডি বেরোয় আশা অডিও থেকে, “His Spirit Within”, এখানে মৈত্রেয়ীর প্রতিটি গানের আগে তারই করা ট্রানস্লেশন পাঠ করেছেন শ্রী সব্যসাচী চক্রবর্তী। এরপর ২ ঘন্টার প্রোগ্রাম করেন “আজ সকালের আমন্ত্রণে”। অনেকবার তারা টিভি তে প্রোগ্রাম করেছেন। কলকাতা ক্যালিডোস্কোপ-এ (চ্যানেল ১ টিভি) প্রোগ্রাম করেছেন। ২০১৮ তে দ্বিতীয় সিডি বার করেন “When the songs came visiting”, এখানে গানের সঙ্গে নিজের লেখা ট্রানস্লেশন নিজেই পাঠ করেছেন।
মৈত্রেয়ী এখন বোষ্টনে আছেন স্বামীর সঙ্গে। দুই ছেলে বড় হয়ে এখন বাড়ীর বাইরে। নিজের ভালোবাসা রবিঠাকুর, তাঁর গান, কবিতা আরো অনেক মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়েছেন ও দিচ্ছেন। মৈত্রেয়ী ভালো থাকুন ও আরো ভালো কাজ করুন এই কামনা করি।
ওলো সই ওলো সই
তোদের এত কি বলিবার আছে ভেবে অবাক হই।
