সহচরীর কলমে / অগাষ্ট ২০২০
প্রকৃতির মুখোমুখি শেষ পর্ব -তাঁবুর বাইরে
কাকলি মজুমদার
“প্রকৃতির মুখোমুখি” প্রথম পর্বে লিখেছিলাম যে এই গ্রীষ্মে প্রকৃতির কাছে ফিরবো। ২০২০ সালটা আমাদের বড় দুঃসময়ে এনে ফেলেছে। করোনার দৌরাত্য, চাকরির অনিশ্চয়তা এবং গভীর অর্থনৈতিক মন্দা। জীবনের এখন আর কোন নিশ্চয়তা নেই। এই নৈরাশ্যে, প্রকৃতিই একমাত্র আশ্রয়। বাড়ির কাছেই রকি মাউন্টেন বড্ড রুপসী। পাহাড়ের বিশালত্বের মধ্যে চলে গেলে, নিজেদের সমস্যাগুলো নিতান্ত জেলো লাগে। প্রকৃতি ধুয়েমুছে সাফা করে নতুন উদ্যোমে জীবনে ফিরিয়ে দেয়। এই মহামারি আমায় শিখিয়েছে যে জীবন বড্ড সংক্ষিপ্ত। দূরে যেতে না পারলেও, হাতের কাছে যা আছে তা করে ফেলতে হবে। চন্দ্রানী ক’দিন ধরে ফোনে বার বার বলছে “camping e যাচ্ছি। চল, ঘুরে আসবি।” তিনি তো সপরিবারে RV তে চেপে Waterton National Park e ক্যাম্পিং করবেন। ওদের RV একটা চলন্ত বাড়ি। শুদ্ধ আর শিউলিও ওখানে ক্যাম্প করবে। এই স্বামী-স্ত্রীর জুটি কেনেডিয়ান বন্ধুদের সাথে ১০ বছর ধরে ক্যাম্প করছে। ওদের গাড়ীর মাথায় তাঁবু ভাঁজকরা থাকে। গাড়ীর উপরে মেলে দিলে দুজনে থাকবার দিব্বি ব্যাবস্থা। সিঁড়ি দিয়ে উঠে তাঁবুতে ঢুকে গেলেই, বিছানা, নরম লেপ সব আছে। ছাদের স্বচ্ছ জানালা দিয়ে আকাশও দেখা যায়। “Rooftop collapsable tent” এই রকম কিছু একটা গালভরা নাম থাকলেও, এটাকে “গাড়ী-বাড়ি” বলা যাক।
ছবি ১) প্রকৃতির মুখোমুখি বন্ধুরা
আমাদের না আছে RV, না আছে তাঁবু। হোটেলগুলো সবে খুলতে শুরু করছে। এখনই নিরাপদ লাগছে না থাকতে। গিয়ে সেদিনই ফিরলে – তিন-তিন ছ’ঘন্টার ড্রাইভ। তাছাড়া Waterton-এ অনেকবার গেছি। চন্দ্রানীর বর অভিজিৎদা বল্লো “আমরা Cardston-এ Fort Heritage Frontier RV Park e ক্যাম্প করছি। Waterton থেকে ৩০ মিনিট। একটা নতুন জায়গা, চলে এসো।”
ছবি ২) আর ভি (R V) ও গাড়ী-বাড়ি
শেষে পর্যন্ত নাছোড়বান্দা বন্ধুদের জন্যই আমাদের শনিবারে কার্ডস্টোনে আসা হোল । ওরা শুক্রবার রাত্তিরে চলে গেছে। কার্ডস্টোন চাষিদের একটা ছোট্ট গ্রাম। মাত্র তিনহাজার লোকের নিবাস। এই RV পার্কটা সবে খুলেছে বলে, বেশি লোক জানে না। তাই কোন ভিড় নেই। আমরা গিয়ে দেখি RV আর “গাড়ী-বাড়ি” পাশাপাশি দাঁড়িয়ে। পিকনিক টেবিলে জোড় আড্ডা চলছে। শুদ্ধ আর শিউলি একটু আগেই পাহাড় থেকে হাইকিং করে ফিরেছে। আমরা আসবো বলে, খুব সকালে গিয়ে ফিরে এসেছে। লকডাউনের আগে স্বাভাবিক জীবনে, আমাদের প্রত্যেক সপ্তাহেই দেখা হোত। কতদিন পরে আবার সবাইকে দেখে কি যে আনন্দ হোল! ক্যাম্প গ্রাউন্ডের এক কোণায় লাল টুকটুকে বাড়ি। সামনে একটা ঘোড়া দাঁড়িয়ে। এরা এই জমির মালিক। আমাদের চারিদিকে যত দূর চোখ যায় ঘন সবুজ ঘাস। সামনে একটা ছোট্ট লেক। দূরে খোলা আকাশের নীচে রকি মাউন্টেন দেখা যাচ্ছে। লেকের জলে হাঁস পরিবার ছানাদের নিয়ে দিব্বি গা ঘেঁষাঘেঁষি করে খেলছে। ওদের সোসাল ডিস্ট্যাসিং-এর দুশ্চিন্তা নেই। যত ঝামালা আমাদেরই। দূরে রাস্তা দিয়ে দু চারটে গাড়ি চলে গেলেই, যা কিছু আওয়াজ। তারপর চারিদিক নিস্তব্ধ। আহা এই শান্তিতে কিছুক্ষণ থেকে, মাথাটা বেশ পরিষ্কার হয়ে গেলো।
ছবি ৩) ক্যাম্প-গ্রাইন্ডের পাশে ফার্ম হাউস
পথে জোরালো হাওয়া পেয়েছি। সৌরভকে রীতিমতন চেষ্টা করে গাড়ী সোজা রাখতে হচ্ছিল। এই অঞ্চলে প্রবল হাওয়াকে কাজে লাগিয়ে উইন্ডমিলে ইলেক্ট্রিসিটি তৈরি হয়। রাস্তার পাশে সারিসারি সাদা পোলের মধ্যে ফ্যানের মতন লাগানো উইন্ডমিলগুলোকে যেন আদিম স্থাপত্যের মতন দেখতে লাগছিলো। কিছুক্ষণের মধ্যে হাওয়ার দৌরাত্যে বাইরে টেকা দায় হয়ে উঠলো। করোনা পরিস্থিতিতে, আমরা সবাই মিলে RV-এর ভিতরে ঢুকতে চাইলাম না। ওটা ওদের পরিবারের লোকেদের জন্যই থাক। শুদ্ধ পাকা ক্যাম্পার। ওর ঝুলিতে নানা ব্যাবস্থা থাকে। সে মাথার উপরে ত্রিপল টানিয়ে দেওয়াতে বাইরে বসা গেলো। আমাদের জোর গল্প-গুজব হাসাহাসি চলছে। এই শান্ত জায়গায় আমরাই একমাত্র সশব্দ।
ছবি ৪) উইন্ড মিলের সারি
কাল রাতে এখানে খুব বৃষ্টি হয়েছে। শিউলি বলছিলো “বাইরে রীতিমতন কনসার্ট শুনতে পাচ্ছিলাম।” আমি ভাবছিলাম “এই উলু জায়গায় কনসার্ট? তাও রাত্তিরে!” শিউলি বলে চলেছে “একটানা ব্যাঙ ডাকছিল। তারপরে ভোঁদর গাইতে শুরু করলো। আমি আর শুদ্ধ বাইরে এসে দেখি ঝিরিঝিরি ঠাণ্ডা হাওয়া বইছে। আকাশটা ছোট-বড় তারায় ছেয়ে গেছে । আকাশের উপর থেকে নীচে ছায়াপথ জেগে উঠেছে।” যদি আকাশ পরিষ্কার থাকে তো, এখানে শহর থেকে দূরে গেলে, লক্ষ-কোটি-তারায় ঠাসা ছায়াপথ দেখতে পাওয়া যায়। একবার আমরাও পাহাড়ে গভীর রাতে ছায়াপথ (Milkyway) দেখেছিলাম। মনে পড়ে গেল যে সেই অপার্থীব দৃশ্যে প্রায় নিশ্বাস বন্ধ হয়ে, গা ছমছম করে উঠেছিলো। এইসব বিরল অভিজ্ঞতা, কে ভোলে?
ছবি ৫) পাহাড়-নদী-প্রকৃতি
এরমধ্যে অভিজিৎদা চা বানিয়ে ফেলেছে। চা-এর সাথে টা খেতে খেতে, আড্ডা আরো জমে উঠেছে। আমি বেমাক্কা শুদ্ধকে বললাম “তোমরা তো সামারে সবসময়ে ক্যাম্পিং-এ যাও। কিসের টানে প্রত্যেক সপ্তাহেই যাও?” ও একটু অবাক হোল। কারণ এতো বছর মেলামেশায় এই প্রশ্ন কখনও করিনি। ও যা বল্লো, তা আমি নিজের ভাষায় লিখছি।
শহরের “concrete jungle”-এ, কাজের চাপে কিছুদিন পরপরই পালাতে ইচ্ছে করে। তাছাড়া কানাডার ভয়াভয় শীতে আমরা তো আট ন’মাস বরফচাপা-বাড়িবন্দী থাকি। তাই সামার এলেই ক্যাম্পিং। চেষ্টা করি প্রত্যেক সপ্তাহে যেতে। জানুয়ারি মাসেই কানাডার সব ক্যাম্পিং-এর জায়গা বুক হয়ে যায়। তাই অনেক আগেই আমাদের প্ল্যান করে নিতে হয়। অনেক বছর ধরে ক্যাম্প করে অভ্যাস। পুরো সিজিনে গাড়ীর পিছনে ছোট-বড় বাক্সে জিনিস গুছানো থাকে। ক্যাম্পের সাথে হোটেলে থাকবার কোন তুলনাই হয় না। আমরা খোলা আকাশের নীচে, গাছপালার মধ্যে, পাহাড়-নদীকে একেবারে জড়িয়ে থাকি। প্রকৃতিতে ফাঁকা জায়গার থাকবার একটা অদ্ভুত নেশা আছে। সকালে পাখিরা তোমায় ডেকে ঘুম থেকে জাগাবে। দিনে পাহাড়ে হাইকিং-এ যাই, সাথে কিছু শুকনো খাবার। আর রাতে ফিরে কাঠের আগুন জ্বালিয়ে তার পাশে চুপচাপ বসে থাকি। কাঠের আগুনেই রান্না হয়। চারিদিকে জন্তু জানোয়ারের ডাক, বহমান নদীর শব্দ। ক্যাম্প করলে বাতাসের প্রত্যেকটা নাড়াচাড়া তুমি অনুভব করতে পারবে। বেশিরভাগ জায়গায় সেলফোন কাজ করে না। তাই বাইরের জগতের থেকে সম্পূর্ণ বিছিন্ন হয়ে যাই। মাথার মধ্যে কোন “to-do-list” নেই। কোন কিছুরই জন্য তাড়া নেই। তাই অনুভূতিগুলো খুব প্রখর -প্রকৃতিমুখি হয়ে যায়। নিজের ভিতরের কত কথা শুনতে পাই। ব্যস্ত জীবনের দৌড়ে যা সাধারণত চাপা পড়ে থাকে। ক’দিনের জন্য একদম রুটিন থেকে হারিয়ে যেতে কি দারুণ যে লাগে! এটা আমাদের সারা বছরের অক্সিজেন দেয়।
আমরা চুপচাপ শুনছিলাম। এবার আমি চন্দ্রানীর দিকে ফিরি। ও বলে RVটা চলমান বাড়ি বলে, এর ভিতরে বাড়ির সব স্বাচ্ছন্দ্যই আছে। ছোট্ট কিচেন, সিঙ্ক, ফ্রিজ, বাথরুম। তবে আমরা ক্যাম্পিং-এ এলে রাতে ঘুমাতে যাওয়া ছাড়া বাকিটা বাইরেই থাকি। “আমার শান্ত জায়গা খুব ভালো লাগে। জানিস, নিস্তব্ধতার একটা আলাদা শব্দ আছে। আমি তা এক মনে শুনি।” সৌরভ বল্লো “তোর RVটা তো চলমান বাঙালি রান্নাঘর। তা আজ পোস্ত বড়া পাওয়া যাবে?” আমি চারিদিকে তাকিয়ে দেখি “এখানে পোস্ত – একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছেনা।” দেখলাম চন্দ্রানী-অভিজিৎদা দুজনেই মিটিমিটি হাসছে।
আরো কিছুক্ষণ জমিয়ে গল্পটল্প করে, এবার আমাদের ফিরতে হবে। ওরা রাতে থেকে কাল ফিরবে। চন্দ্রানী আজ ডিনারের ব্যবস্থা করেছে। আমরা আগে খেয়ে নেবো। RVতে খাবার গরম হয়ে এল। আরি বাব্বা – ভাত, মাংস, মেথিশাক আর …প্লেটের এক পাশে দুটো পোস্ত বড়া। না ঠিকই পড়ছেন – কার্ডস্টোন ক্যাম্পিং-এ এসে পোস্ত বড়া খাওয়া হোল। এবার তাঁবুর বাইরে থেকেই ফিরে এলাম। দেখা যাক, যদি পরের বছরে সবাই মিলে ক্যাম্পিং করা যায়।
শেষকথা 👉 লকডাউনের শুরুতে, বন্ধু অরুন্ধতীর উৎসাহে ওর ব্লগ সহচরীতে লিখেছিলাম। তারপরে আর এক বন্ধু তোয়াই-এর অনুপ্রেরণায় নিজের Facebook page সফরনামচা খুলে লিখতে শুরু করেছি। অরুন্ধতী আর তোয়াই – তোমাদের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। লেখার মধ্য দিয়েই আমি মুক্তির স্বাদ পাই। সবাই ভালো থাকুন।
ফটো সৌজন্য – শিউলি রায়, সৌরভ মজুমদার
লেখিকা পরিচিতিঃ কাকলির জন্ম এবং পড়াশুনা কলকাতায়। সে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানের স্নাতকোত্তর ছাত্রী। বর্তমানে কাকালি কানাডার ক্যালগেরি শহরে থাকে সপরিবারে। অনেক দেশ ঘুরেছে। লেখা তার বহুদিনের সৃষ্টিশীল ভালোবাসা। তার লেখায় ছুঁয়ে থাকে প্রকৃতি, প্রেম পূজা আর মানুষের কাহিনী। কিছু গভীর অনুভবের আর অনুপ্রেরণার উপলব্ধি। সে লেখে নানা স্বাদের ছোট গল্প, প্রবন্ধ, আর ভ্রমণ কাহিনী। তার বেশ কিছু লেখা প্রকাশিত হয়েছে দেশ, সাপ্তাহিক বর্তমান ও অন্যান্য পত্রিকায়।