সহচরী ১৭ ২য় পর্ব/ সুস্মিতা ঘোষ/জুলাই ২০২০
ছবি ১) সুস্মিতা ঘোষ
আবার ফিরে এলাম ১৭ নং সহচরীকে নিয়ে। আগের পর্বে বলেছিলাম সুস্মিতার জীবনের এক পর্বের কথা। এবারে বলব তার জীবনের আরেক পর্বের কথা। আগের পর্বে যে সুস্মিতাকে দেখেছি, এবার তাকে সম্পূর্ণ অন্যরূপে দেখব। জানব মা সুস্মিতা, সবায়ের সুস্মিতাদি, বাংলা স্কুলের সুসি মাসী ও রামকৃষ্ণ বেদান্ত সোসাইটি অফ পিটস্বার্গের “দি” হিসেবে।
এবার একটু পিছিয়ে যাই। সময়টা ১৯৮৪ সাল। বিয়ে হয়ে কুনালের সঙ্গে এলেন আইওয়াতে। দুবছর পরে তাদের প্রথম সন্তান সায়ন এল পৃথিবীতে। এরপর কুনালের পি এইচ ডি শেষ হলে পরিবারটি রওনা দিলেন জ্যাকসন, মিসিসিপির দিকে। এখানেই কুনালের অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর হিসেবে কাজ শুরু হল। নতুন শহরে নতুন সংসার। সুস্মিতা চেষ্টা শুরু করলেন ডেন্টিস্ট্রি পড়ার ব্যাপারে। জানলেন সবকিছু আবার নতুন করে শুরু করতে হবে। ঠিকঠাক খবর পান নি, আর মিসিসিপি ছোট জায়গা। যাই হোক আরো দেড় বছর সায়নের সঙ্গে কাটিয়ে সায়নের প্রি-স্কুলে যাওয়া শুরু হতে তিনিও জ্যাকসন স্টেট ইউনিভারসিটিতে এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স (Environmental Science) -এ মাষ্টার্স করতে শুরু করলেন। মাস্টার্স এ রিসার্চ করতেন বলে সকালে ছেলেকে প্রি স্কুলে দিয়ে ল্যাব এ যেতেন, প্রি স্কুল শেষ হলে বাড়ি ফিরে রাতে আবার ক্লাস। মাষ্টার্স এ প্রথম বছর থেকেই স্থানীয় কম্যুনিটি কলেজে পার্ট টাইম পড়াতে শুরু করলেন। ১৯৯০ তে যখন মাষ্টার্সের থিসিস লিখছেন, তখন ছোট ছেলে দীপন হল। এরপর আর না থেমে পি এইচ ডি তে যোগ দিলেন ডাঃ রাইন এর কাছে। বাবা বিয়ের সময় কুণাল কে বলেছিলেন “ওর যা পোটেন্সিয়াল, উচ্চশিক্ষা করে ভালো লাগবে।” প্রথম বছর দীপনের ডে-কেয়ার নিয়ে একটু ঝামেলা হল। যা দেখলেন, পছন্দ হল না। অবশেষে একটিতে সপ্তাহে তিনদিন রাখতেন, বাকী সময়ে সঙ্গে কাজে নিয়ে যেতেন। ল্যাবরেটরীতে লেড, ক্যাডমিয়াম নিয়ে কাজ হত, ছোট্ট দীপনকে বেশী নিয়ে যেতে চাইতেন না। শ্বশুর – শাশুড়ি প্রত্যেক দুবছরে ছয়মাস করে এসে থাকতেন তাদের সঙ্গে।এসবের মধ্যেই দীপনের কিন্ডারগার্ডেনের সময় হয়ে গেল। ইতিমধ্যে অসম্ভব ব্রিলিয়্যান্ট বড়ছেলে সায়ন ৫ বছরের মধ্যে ১-৮ ক্লাসের সবকিছু শেষ করে মাত্র ৯ বছরে ক্লাশ নাইনে ভর্তি হয়ে ১৩ বছরের মধ্যে ১২ ক্লাশ পাশ করল। মায়ের পি এইচ ডি আর ছেলের হাই স্কুল গ্রাজুয়েশন একসঙ্গে হল। এবার কলেজে ভর্তি হতে হবে।কিন্তু ১৩ বছরের ছাত্রকে কোনো কলেজ নেবে না। ইউনিভার্সিটি অফ মিনেসোটা, মিসিসিপি স্টেট ইউনিভার্সিটি অনেক টাকা স্কলারশিপ দিল। সায়ন কারনেগি মেলন ইউনিভার্সিটিতেও চান্স পেল। কিন্তু ওরা জানাল পুরো পরিবারের ইন্টারভিউ নেবে সায়ন এত ছোট বলে। ওদের এই পরিবারটিকে ভালো লাগল। ভর্তি হযে গেল সায়ন। ঠিক হল সুস্মিতা সায়নকে নিয়ে পিটস্বার্গে আসবেন, আর দীপন কুণালের সঙ্গে ক্লিনটনে থাকবে। ইতিমধ্যে কুণাল টেনিওর্ড (Tenured) হয়ে তিনটে ডিপার্টমেন্টের হেড হয়ে গেছেন। বেশ ভালোই ছিলেন চারজনে ক্লিনটনে। কিন্তু এটা তাদের অত্যন্ত মেধাবী ছেলের খুব অল্প বয়সে কলেজে ভর্তি হবার ব্যাপার, কাজেই যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সব যখন প্রায় ঠিক, ছোটছেলে দীপন বেঁকে বসল। এইরকম আলাদা থাকার ব্যাপারে সে একটুও রাজী নয়। খুব কান্নাকাটি করতে লাগল সে। কুণাল তখন পিটস্বার্গে স্যাবাটিক্যাল নিয়ে আসবার চেষ্টা করতে লাগলেন। কারনেগি মেলন সব শুনে একটা বিশেষ পোষ্ট (Teaching Professor and Assistant head for the Undergraduate Affairs) তৈরী করে তাকে নিয়োগপত্র পাঠিয়ে দিল। সায়ন কে সিএমইউ এক সেমিস্টার জ্যাকসন স্টেট এ পড়ার অনুমতিও দিল। ফলে গুছিয়ে গাছিয়ে ডিসেম্বরে ক্লিনটনের পাট চুকিয়ে এই পরিবারটি পিট্সবার্গে চলে এল।
ছবি ২) বিয়ের পর কুণাল-সুস্মিতা
নতুন শহর, সবই নতুন! স্বামীর চাকরী, বড় ছেলের কলেজে পড়াশুনা, ছোটছেলের স্কুল- এসবের সঙ্গে সঙ্গে সুস্মিতা Adjunct Faculty হিসেবে কারনেগি মেলন-এ পড়াতে লাগলেন। কারনেগি মেলনের প্রভোস্ট (Provost) তাকে বলেছিলেন এডুকেশনের ডিগ্রী নিয়ে নিতে। কিন্তু তখন ছেলেরা ছোট, তার ওপরে আর পড়াশুনা করতে তিনি চাইলেন না। বেশ কিছুদিন পড়িয়েছেন।
এবার সুস্মিতার অন্য আরেকটি দিক নিয়ে কিছু বলব। এর জন্য অবশ্য আমাদের আবার একটু ক্লিনটন, মিসিসিপিতে ফিরে যেতে হবে, আবার ফিরে আসব পিট্সবার্গে। সন্তান হবার আগেই তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে বাচ্চাদের বাঙলা শেখাতে হবে। তারা যেহেতু দুজনেই খুব সঙ্গীতপ্রিয়, বড় ছেলে খুব ছোটবেলা থেকেই নানা রকমের বাংলা গান শুনে অভ্যস্ত।বাড়ীতে বাংলায় কথা বলতেন। অতটুকু ছেলে সবজায়গায় গেলে বাংলায় ঝরঝরে কথা বলে দেখে ক্লিনটন ও তার আশেপাশের বাঙ্গালী পরিবারেরা তাকে ধরল যে তাদের ছেলেমেয়েদের ও বাংলা শেখাতে হবে। ১৯৯২ সালে মিসিসিপিতে বাংলা স্কুল প্রথম শুরু হল “মিসিসিপি বাংলা একাডেমী” নামে। ক্রমে ক্রমে ওখানে নববর্ষ, সরস্বতী পুজা, বিজয়াসন্মেলনী ইত্যাদিতে যত প্রোগ্রাম হত, বাংলা স্কুলের বাচ্ছারাই প্রোগ্রাম শুরু করত। ৮-৯ টি বাচ্ছা নিয়ে স্কিট তৈরী করে সায়নের গান, অন্যান্য বাচ্ছাদের নাচ ইত্যাদি নিয়ে ৩০ মিনিটের এক একটি সম্পূর্ণ অনুষ্ঠান করিয়েছেন। এরপরে ছোটছেলে দীপনও ছিল ওখানকার স্টুডেন্ট। ইউনিভার্সিটি অফ মিসিসিপির ক্যাম্পাসে একটি কমুনিটি হল ছিল। সেখানে চলত বাংলা একাডেমীর ক্লাশ শুক্রবার, একসপ্তাহ অন্তর। বড়রাও আসতেন, যারা কোনোদিন বাংলা শেখেন নি। পিট্সবার্গে যখন এলেন, তার দুই ছেলের বাংলা শুনে সবাই অবাক। এখানকার মায়েদের উৎসাহে বাংলা স্কুল শুরু হল ২০০৩ সালে পিট্সবার্গে, নাম পাঠশালা। অনেক ছেলেমেয়ে এখানে বাংলা শিখে বেরিয়ে গেছে। বড়রাও পড়েছে এবং পড়ে। ২২-২৫টি বাচ্ছা নিয়ে বাংলা স্কুলের ক্লাশ চলে। উচ্চারণে তিনি জোর দেন। প্রতিবছর এই বাচ্ছাদের নিয়ে বেঙ্গলী অ্যাসোসিয়েশন অফ পিট্সবার্গ-এর অনুষ্ঠানে নাটক করেন। এটি খুব জনপ্রিয়। বাচ্ছাদের তার বাংলাস্কুলের স্ন্যাক খুব ভালো লাগে।তাদের কাছে তিনি সুশিমাসী, বাংলামাসী, দিদা ইত্যাদি অনেক নামে পরিচিত। সুস্মিতা চান যে ছোটরা যেন বাংলাকে ভালোবেসে বাংলা বলে। ওদের লেসন্ প্ল্যান (lesson plan) তৈরী করেন সেভাবেই। পাঠশালার এখন বয়স ১৭ বছর।
ছবি ৩) সুস্মিতা ঘোষ
এবার আসব সুস্মিতার রামকৃষ্ণ বেদান্ত সোসাইটি অফ পিট্সবার্গের “দি” হয়ে ওঠার গল্প নিয়ে। সত্যি গল্পের মতোই, কিন্তু সত্যি ঘটনা। বিয়ের পর দীক্ষা নিতে গেছিলেন বেলুর মঠে, কিন্তু সেবার হয়নি। পিট্সবার্গে এসে শুনলেন হলিউড আশ্রমের প্রধান মহারাজ স্বহানন্দজী এখানে ভক্তদের বাড়ীতে আসেন। ২০০২ সালের মে মাসে এল সেই সুসময়। প্রথম দর্শনেই মনে পড়ল নিজের শ্বশুরমশাই এর কথা, যার কাছে তিনি অনেক ভালোবাসা পেয়েছেন। প্রথম দর্শনেই ভগবানের আসনে বসালেন, প্রণাম করলেন। প্রথম বছরে সুস্মিতার ও তার পরের বছর কুণাল ও দুই ছেলের দীক্ষা হল।এরপর যখনই মহারাজ এসেছেন, সুস্মিতারা সপরিবারে মহারাজের সঙ্গে দেখা করেছেন। মহারাজের ইচ্ছায় পিট্সবার্গে একটি বেদান্ত আশ্রম খোলার আলোচনা চলতে লাগল। সুস্মিতা মহারাজের নির্দেশে বাড়ী দেখতে শুরু করলেন। কাছেই একটি বাড়ী পাওয়া গেল, বিক্রীতে আছে।মহারাজের নির্দেষে ও হলিউড বেদান্ত সেন্টারের অর্থে বাড়ীটি কেনা হল। কিন্তু শুধু কিনলেই তো হবে না, কাজের শেষ নেই। বাড়ীটিতে অনেক কাজ করাতে হবে। সুস্মিতা একাই লেগে পড়লেন। লোক ঠিক করে বাড়ীটি আশ্রমের উপযুক্ত করার চেষ্টা চলতে লাগল। রোজ সকালে কুণাল কাজে বেরিয়ে যেতেই তিনি ছোট ছেলেকে নিয়ে চলে যেতেন আশ্রমের বাড়ীটিতে বাড়ী পরিষ্কারের কাজে। দীপন সেই বছরেই গ্রাজুয়েট স্কুলে চলে যাবে। তার আগের একটু অবসর সময়ে সে পরিষ্কারের কাজে মাকে সাহায্য করতে লেগে পড়ল। মহারাজ বাড়ী দেখতে এলেন, বলে গেলেন সেপ্টেম্বরের ২০ তারিখে আশ্রমের উদ্বোধন হবে। সুস্মিতা একটা Remodeling এর প্ল্যান করেছিলেন। মহারাজ বলে দিলেন যে যাবতীয় খরচ মহারাজ দেবেন। ইতিমধ্যে আরেকজনকে সুস্মিতা পেয়ে গেলেন।অল্পবয়সী যুবক নাম হরিচরণ মন্ত্রিপ্রগাদা, কার্নেগী মেলন এ সদ্য Ph.D করে Post Doctoral Fellow হিসেবে কাজ করছে। তার ইচ্ছে সে আশ্রম প্রতিষ্ঠার ব্যপারে সাহায্য করবে। সেই শুরু হল যাত্রা। সব কাজ সুষ্ঠ ভাবে হয়ে গেল। ২০০৯ সালে আশ্রমের উদ্বোধন হল। তিনি মহারাজের নির্দেশে জেনারেল ম্যানেজার নিযুক্ত হলেন। তার কাজ হল গোটা আশ্রমের তদারকি করা। এক কথায় জুতো সেলাই থেকে চন্ডী পাঠ করা। মহারাজ বছরে দুবার করে আসতেন। এছাড়াও অন্যান্য মহারাজরা বিভিন্ন সেন্টার থেকে আসতে লাগলেন, লেকচার, আধ্যাত্মিক আলোচনা চলতে লাগল। বেলুর মঠের তালিকা অনুযায়ী আশ্রমে নানাবিধ উৎসব ও চলতে লাগল। ভক্তরাও আসেন। তাদের সাহা্য্যে আশ্রম একটা পূর্ণাঙ্গ আশ্রমে পরিণত হয়ে উঠলো। ক্রমশঃ একটি বাড়ীতে আর আশ্রমের স্থান সঙকুলান হল না। মহারাজরা এলে, অন্যান্য স্টেট থেকে ভক্তরা আসেন। থাকবার অসুবিধা। আশ্রমের বাড়ীটির পাশেই আরেকটি বাড়ী বিক্রীতে ছিল।মহারাজের নির্দেশে সেই বাড়ীটি কেনা হল ২০১১ সালে। এখন পাশাপাশি দুটি বাড়ীতে পিট্সবার্গের রামকৃষ্ণ আশ্রম অবস্থিত। নতুন বাড়ীটিতে একটি লেকচার হল, মহারাজদের থাকবার ব্যাবস্থা, নিচে রান্নার ও খাওয়ার ব্যাবস্থা। প্রথম বাড়ীটিতে মন্দির, লাইব্রেরী এবং নীচে মহিলাদের থাকবার জন্য একটি বড় ঘরের ব্যাবস্থা হয়েছে। দুটি বাড়ীর পিছনের লনকে একত্র করে একটি বড় পার্কিং-এর ব্যাবস্থা হয়েছে। সবকিছু একদিনে হয়নি। আস্তে আস্তে হয়েছে। এর পিছনে কিন্তু আছেন সুস্মিতা এবং আশ্রমের ভলান্টিয়াররা।সব ছেলেমেয়েদের কাছে তিনি “দিদি” বা “দি”। এইভাবেই সুস্মিতা অক্লান্তভাবে কাজ করে চলেছেন। ২০১৯ এ আশ্রমের ১০ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে বেশ বড় করে অনুষ্টান হয়েছে প্রেসিডেণ্ট মহারাজ শ্রী সর্বদেবানন্দজীর উপস্থিতিতে। এখানে একটা কথা বলার আছে।সুস্মিতা তার সব কাজেই কুণালকে পাশে পেয়েছেন। স্বহানন্দজী মহারাজ দেহ রেখেছেন। তিনি বলতেন, “তোমরা একদম একটা Presbyterian Minister Couple, কুণাল কথা বলবে, আর তুমি কাজ করবে”।
বাংলা স্কুল এবং আশ্রমের কাজ ছাড়াও সুস্মিতা এখানকার স্থানীয় বাঙ্গালী সংগঠন বেঙ্গলী অ্যাসোসিয়েশন অফ পিট্সবার্গের (BAP) সঙ্গে যুক্ত দীর্ঘদিন ধরে। পরপর দুবছর প্রেসিডেন্ট হিসেবে কাজ করেছেন। এছাড়াও বাচ্ছাদের নিয়ে নিয়মিত অনুষ্ঠান করেন। কুণাল সম্প্রতি অধ্যাপণা থেকে অবসর নিয়েছেন। বড়ছেলে সায়ন কম্পুটার সায়েন্টিষ্ট এবং Lawyer , চাকরী করে ডিসিতে। ছোটছেলে দীপন ইয়েল স্কুল থেকে নিউরোসায়েন্স এ পি এইচ ডি করে বর্তমানে বোষ্টনের এম আই টিতে পোষ্ট-ডক্টরাল সায়েন্টিষ্ট। এইভাবে স্বামী কুণাল, দুই ছেলে, বড়ছেলের স্ত্রী প্রিয়া (হেল্থ কনসালটেন্ট) এই নিয়ে তার সংসার। সুস্মিতা ভাল থাকুন, আরো কাজ করুন মানুষের জন্য এই কামনা করি।