সহচরী ১৭ ১ম পর্ব/ সুস্মিতা ঘোষ/ জুন ২০২০
স্থান বাংলাদেশের প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল, গাঁয়ের পথ দিয়ে একটি পালকি চলেছে। পালকির মধ্যে বসে আছে ১৮ বছরের একটি নববধূ। বিয়ে হয়ে চলেছে শ্বশুরবাড়ী। রাস্তা আর ফুরায়না। প্রথমে ট্রেনে, তারপর ভ্যানরিক্সা, তারপরে পালকি। একভাবে বসে আছেন কোনরকমে পালকির মধ্যে, নড়াচড়া করা যাবে না। গ্রামের পর গ্রাম পার হয়ে যাচ্ছেন। পৌঁছলেন প্রায় মাঝরাতে। শাঁখ, উলু দিয়ে বউ বরণ হল।সবাই ভালো করে মেয়েকে মেপে দেখে নিল সব ঠিকঠাক আছে কিনা। মাথার চুল, হাত, পা ইত্যাদি। মনে হচ্ছে খুব আগেকার কথা তাই না? সময়টা কিন্তু খুব আগেকার নয়। ১৯৮০ সালের কথা। নতুন বর পড়েন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, এম-ফিল করছেন কেমিষ্ট্রি্তে, নতুন বউটি পড়ে ঢাকার ডেন্টাল স্কুলে। সবে দ্বিতীয় বছরে উঠেছে। এই বিয়ের কথা চলছিল অনেকদিন ধরে। সম্বন্ধ এসেছিল আগেই ছেলের বাড়ী থেকে। তখন মেয়ে স্কুলে পড়ে, তাই বিয়ে হয় নি। এরপর স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে, ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে কলেজে ভর্তি হতে আর ঠেকিয়ে রাখা গেল না।
এই মেয়েটি হলেন আমার এবারের সহচরী, নাম সুস্মিতা ঘোষ। বিয়ের ঘটনা দিয়ে শুরু করলেও ফিরে যাব সুস্মিতার ছোটবেলায়। জন্ম এবং বড় হওয়া সবই বাংলাদেশে। বাবার আদি বাড়ী যশোরে। কাকা পরবর্তী কালে পশ্চিমবঙ্গে চলে এলেও বাবা বাংলাদেশে রয়ে যান। পেশায় উকিল বাবার বদলীর চাকরী ছিল। সুস্মিতার জন্ম হয়েছে বগুরায়। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে সবার ছোট তিনি। তিন বোন, দুই ভাই। বড় দিদি সুস্মিতার থেকে ১৮ বছরের বড়। দিদির কাছে খুব আদরে বড় হয়েছেন। ছোটবেলা থেকে বিয়ের আগে অবধি জীবণ ভরে ছিল আনন্দে। মা ছিলেন খুব করিতকর্মা। সাংসারিক কাজকর্ম ছাড়াও ভালো লিখতে পারতেন। যখনি সময় পেতেন লিখতেন। তখনকার দিনে “বেগম” পত্রিকার নিয়মিত লেখিকা ছিলেন।
৪ বছর বয়সে বাবার কর্মসুত্রে দিনাজপুরের এক গ্রামে বদলী হলে তারা সবাই চলে এলেন সেখানে। বড়দি তখন ঢাকা ইডেন কলেজে থেকে বেড়িয়ে এক কনভেন্ট স্কুলের শিক্ষিকা, বড়দা ঢাকা কলেজে পড়ছেন। ঢাকা শহর থেকে এসে গ্রামের মধ্যে ওদের কিন্তু কোনো অসুবিধাই হল না। মা কিছুদিনের মধ্যেই সবাইকে আপন করে নিলেন। স্কুলের অনুষ্ঠানগুলোতে নিজে নাটক লিখে, গান তৈরী করে, শিখিয়ে, পোষাক বানিয়ে মজাদার সব অনুষ্ঠান নামিয়ে দিতে পারতেন।
এরপর ৮ বছর বয়সে সুস্মিতা বাবার কর্মসুত্রে দিনাজপুর শহরে এসে সারদেশ্বরী স্কুলে ভর্তি হলেন। ততদিনে দিদির বিয়ে হয়ে গেছে ভারতের জলপাইগুড়িতে। দাদাও চাকুরী সূত্রে দেশের বাইরে। মা, বাবা, ছোড়দি, ছোড়দা আর ছোট সুস্মিতাকে নিয়ে এক আনন্দের পরিবার। ছোড়দির খুব জীব জন্তু পোষার বাতিক ছিল। একবার ছোড়দির সখ হল বাড়ীতে মুরগী পুশবে। তার সাকরেদ ছিলেন সুস্মিতা। এরমধ্যে একটি কালো, আরেকটি মেরুণ মুরগী ভালো ডিম দিত। তারা গাছে ঝাঁপ দিতে দিতে ডিম পাড়ত, আর সুস্মিতার কাজ ছিল মুরগী কলাগাছে চড়লেই হাতে বাস্কেট নিয়ে সেই পড়ন্ত ডিম ধরে ফেলার। এছাড়াও বেড়াল,কুকুর, হাঁস তো ছিলই। একবার গরুর শখ ও হয়েছিল, কিন্তু মায়ের বকাতে সে আর হয় নি।
ছোটবেলা থেকেই খুব খোলামেলা পরিবেশে বড় হয়েছেন। পড়া শেষ করে রোজ ছোড়দার সঙ্গে পাড়া টহল দিতে বেরোতেন। বেড়াল, কুকুরদের ঘুম থেকে তুলে দিতেন, তারা কিরকম করে আড়মোরা ভাঙ্গে আর কি কি করে খুব নকল করে দেখিয়ে সবাইকে আনন্দ দিতেন। বাড়ীর সবাই রবীন্দ্রসঙ্গীত ভালোবাসতেন। ছোড়দা তাকে রবীন্দ্রসঙ্গীতের বৈচিত্রময় অনেক গান জোগাড় করে শোনাতেন। রবিবারের ছায়াছবির গানের অনুষ্ঠান ছিল ছিল সবার প্রিয়। বাড়ীতে ছিল অনেক বই, পড়েছেন এবং মায়ের কাছে শুনেছেন। বাবা ইংরেজী সাহিত্যের ছাত্র ছিলেন। নাটক, কবিতা সব মুখস্থ ছিল। এভাবেই তিনি শুনে শুনে বড় বড় সব বিখ্যাত কবির কবিতা শিখেছেন। ম্যাকবেথ, ওথেলো, এসবও বাবা অনায়াসে বলে যেতেন। তখন তিনি পঞ্চম শ্রেণিতে পড়েন। তাদের বাড়ীর রাস্তার পাশে এক বিশাল কালিবাড়ী ছিল, সঙ্গে এক বিশাল বটগাছ। একদিন হঠাৎ শোনেন চিৎকার! এক পকেটমারকে ধরে সবাই খুব মারছে। তিনি আর কিছু না ভেবেই সটান গিয়ে তার ওপর গিয়ে পড়লেন আর বলতে লাগলেন “ওগো ওকে তোমরা মেরো না, ওকে পুলিশে দাও।” পিটুনি থেমে গেল। সবাই পকেটমারকে থানায় নিয়ে গেল। এদিকে বাড়ীতে মা লাঠি নিয়ে বসে আছেন মেয়েকে শাসন করবেন বলে। বাবা বললেন “তোকে নিয়ে আমার গর্ব হচ্ছে!” ছোড়দি বললেন “মা তোমার এই মেয়ে পাগল!” একবার হল কি মা সেলাই করছিলেন সেলাই কলে। সুস্মিতা গেছেন বন্ধুদের সাথে খেলতে।অন্যমনস্ক হয়ে হাতের ওপর মেশিন চালিয়ে দিলেন। তর্জনীতে সূঁচ ঢুকে গেল। ছোড়দি দেখে চিৎকার করতে লাগল, ছোড়দা দেখেই বাড়ী থেকে বেরিয়ে সুস্মিতাকে ডাকতে গেল। সুস্মিতা গিয়ে মায়ের আঙ্গুলটা ধরে দাঁত দিয়ে সূঁচটা বার করে দিলেন। যেন কিছুই হয়নি।মা মেয়েকে দেখে অবাক হয়ে গেছেন। এরপর অ্যান্টিবায়োটিক ক্রিম লাগানো হল। সেই দিন খেতে বসে শোনেন মা বাবাকে বলছেন “একে ডাক্তার বানানো উচিৎ।” তখন সুস্মিতা পড়েন সপ্তম শ্রেনিতে।
এরপর ছোড়দি রাজসাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ও ছোড়দা ঢাকায় মেডিক্যাল কলেজে পড়তে গেলেন। কিছুদিন পর সুস্মিতা ঢাকায় গেলেন ইন্টারমিডিয়েট পড়তে ইডেন গভর্ন্মেন্ট গার্লস্ কলেজে বিজ্ঞান নিয়ে। পড়াশুনায় বরাবর ভালোই ছিলেন, বৃত্তিও পেয়েছেন স্কুলে ও কলেজে। মেডিক্যালের বদলে ডেন্টিস্ট্রি নিয়ে পড়বেন ভাবলেন। ইডেন কলেজে পড়ার সময়ে একবার দাঁতের ব্যাথায় কষ্ট পেয়েছিলেন। ছোড়দার ডেন্টিষ্টবন্ধু আনসারীভাই তার দাঁতের ফিলিং করে দিলেন, সব ব্যাথা চলে গেল।সেই দেখে তার মনে হল “ডেন্টিষ্ট হলে আমি তো লোকের দাঁতের ব্যাথা এক পলকে ভালো করে দিতে পারি!” বাবাকে বোঝাতে হল। বললেন যে ডেন্টিষ্ট্রি তার ভালো লাগে, ডেন্টিষ্টদের এমারজেন্সি ডিউটি থাকে না, ছোটাছুটিও কম। ভর্তি হয়ে গেলেন ঢাকা ডেন্টাল কলেজ এ (Dhaka dental college and hospital)।খুব ভালো লাগল ডেন্টিষ্ট্রিতে পড়তে ঢুকে। পড়াশুনায় বরাবরি ভালো ছিলেন।ভেবেছিলেন ওরাল সার্জেন (Oral Surgeon) হবেন। কিন্তু পড়া শেষ হবার আগেই বিয়ে হয়ে গেল। তখন সুস্মিতা থাকেন মেডিক্যাল কলেজের হোষ্টেলে।
এবার বিয়ের কথায় আসি। স্কুলে পড়ার সময়েই বিয়ের সম্বন্ধ এসেছিল, বিয়ের কথা ঠিক হয়ে ছিল। আগেই বলেছি পাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কেমিষ্ট্রিতে এম-ফিল করছে। ডেন্টাল কলেজে দ্বিতীয় বছরে ওঠার পর বিয়ের দিন ঠিক হল। এরমধ্যে একদিন হবু বরের সঙ্গে দেখা করলেন। প্রথম আলাপে খুব একটা অভিভূত হলেন না। তবুও ভাবলেন কিছু করার নেই, অনেকদিন ঠিক হয়ে আছে। বাবার একটাই ইচ্ছা ছিল মেয়েকে পড়তে দিতে হবে। বিয়ে হয়ে গেল। স্বামীস্ত্রী ঢাকায় ফিরে এলেন। যে যার নিজের মত হোষ্টেলে থাকতেন।মাঝে মাঝে সিনেমা দেখতে যেতেন একসঙ্গে, কিন্তু ফিরে আসতেন মনখারাপ নিয়ে। কথা হলেই দুজনের মতের অমিল হত। সবসময়ে সুস্মিতার দোষ দেখেন, তার সবকিছুতেই আপত্তি। ছোটদেওর পড়তো ঢাকা মেডিক্যালে। তার কাছ থেকে অনেক উল্টো-পাল্টা খবর পেত আর দেখা হতেই দুজনের অশান্তি হত। এরপর পরবর্তী দুটো বছর তার জীবণ দুর্বিসহ করে দিয়েছিল। কোন অধ্যাপক স্নেহ করতে পারবে না, কোন বন্ধু হতে পারবে না ইত্যাদি অনেক শর্ত। যখনি মনখারাপ নিয়ে হোষ্টেলের ঘরে ফিরে আসতেন, সবচাইতে কাছের বন্ধু চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে বলত “ছাইর্যা দাও।” এরপর মাষ্টার্স করতে বর চলে গেলেন ক্যানাডায়। তিনি ডেন্টাল পাশ করে ওরাল সার্জারীতে ইন্টার্ন করতে শুরু করলেন। এদিকে বাড়ী থেকে বাবা-মা বলছেন ক্যানাডা যেতে। কি করবেন জানতে চাইলে বর লিখলেন, “বাবাকে বলো টাকা দিতে। কিছুই শিখলে না। বাবা-মায়ের কাছে টাকা নিতে শেখো।” সুস্মিতাও জেদী, কিছুতেই বাবার কাছে টাকা নেবেন না। বলেই দিলেন, “তাহলে আমি যাবো না।” অবশেষে বরের টিকিটে যাবার দিন ঠিক হল। তিনি পাড়ি দিলেন সুদূর ক্যানাডায়। ওখানে তারা একটি পরিবারের বাসায় একটি ঘর ভাড়া নিয়ে থাকবেন। ভাই আর ভাবী, তাদের দুই বাচ্ছা। এক বাসায় থাকলেও তাদের রান্না আলাদা। তিনি দেখলেন তার স্বামী তার হাতে একটি পয়সাও দেন না, সকালে, বিকেলে কি রান্না হবে সব বলে দেন। এবং খাবার ব্যাপারে তার জন্য সবকিছু মাপামাপি। এই নিয়ে সুস্মিতা কোনদিন কোন প্রশ্ন তোলেন নি। মুরগী রান্না হলে, দুটো ড্রামস্টিক (Drumstick, মুরগীর ঠ্যাং) ও একটা উয়িং (wing, ডানা) রান্না হবে। সুস্মিতা যেহেতু মেয়েমানুষ, তাই তার জন্য বরাদ্দ কম পয়সার ডানার মাংস। ছোট থেকেই কখনো কিছু চাওয়ার অভ্যেস ছিল না। তাই কোনদিনই এই ব্যাপারে কিছু বলেন নি, মুখ বুজে থেকেছেন। মাঝে মাঝে ভাবীর সঙ্গে বাজারে যান।সংসারের যা কিছু বাজার হয় সব দাম ভাবী দেন, পরে তার স্বামীর কাছ থেকে নিয়ে নেন। ভাবী দেখেন এদের সংসারের অদ্ভুত নিয়মকানুন, বেশ কয়েকবার তাকে উপদেশ দিয়েছেন, সাবধান করেছেন, কিন্তু সুস্মিতা গায়ে মাখেন নি। এদিকে দেশ থেকে বাবা চিঠিতে লিখলেন পড়াশুনা শুরু করার কথা। স্বামীকে বলতে উড়িয়ে দিলেন।
এরপর তারা এলেন আইওয়া স্টেট ইউনিভার্সিটিতে পি এইচ ডি করতে। সদ্যাগত বাঙালি ছাত্র-ছাত্রীদের বাড়ীতে নেমন্তন্ন করলেন ভেটেরিনারী স্কুলের প্রফেসর ও তার স্ত্রী। প্রচুর রান্না। বিশাল টেবিল জুড়ে এলাহি ব্যাবস্থা। এখানে শুনলেন কুণাল ঘোষ নামে আরেকজন বাঙালি ছাত্র এসেছে ফিজিক্সে পি এইচ ডি করতে, সে টিচিং অ্যাসিস্ট্যান্ট। পড়িয়ে আসতে তার দেরী হবে। সবাই খাবার নিয়ে টিভিতে সিনেমা দেখতে বসেছে ড্রয়িংরুমে। এমন সময়ে একজন এসে ঢুকলেন। তিনি এত খাবার দেখে কোথা থেকে শুরু করবেন বুঝতে পারছেন না। সুস্মিতা তাকে সব দেখিয়ে বুঝিয়ে দিলেন। পরেরদিন সকালে কুণাল ফোন করে তাকে ধন্যবাদ জানালেন, সেই থেকে কুণাল এই পরিবারের পরিচিত হয়ে গেলেন। সুস্মিতারা থাকে স্টুডেন্ট আপার্ট্মেন্টে। আবার সেই হিসেব করে জীবণ। প্রত্যেক পাই-পয়সা গুনে বাজার। বাসে করে বাজার করতে যেতেন, বাজার বয়ে এনে রান্না করতেন রোজ দুটো ড্রামস্টিক আর একটা ডানার ঝোল। বাজার হত সাতদিনের সাতটা কমলালেবু তার স্বামীর জন্য। কথা শুনতে হত “এই যে তুমি প্রতিদিন চা খাও, আমার পাঁচ সেন্ট করে রোজ যায়। তুমি তো আবার দিনে দুবার চা খাও।” বাড়ীতে লোক ডেকে খাইয়ে রান্নার প্রসংশা পেলে বা পার্টিতে গিয়ে গান গাইলে, মজার কথা বললে, তার স্বামী বিরক্ত হতেন। আর সমানে তার নিজের বাড়ীর লোকের নিন্দে শুনতে হ্ত। এরমধ্যে আরো ঝামেলা জুটল। কোর্স ওয়ার্কে ফিজিক্যাল কেমিস্ট্রির পরীক্ষায় তার বর সি ( C ) পেতে লাগলেন। যত ব্যার্থতা আসতে লাগল, ততই তার রাগ বেড়ে যায়। একদিন কুণালকে জিজ্জেস করে বসলেন “তুই কেমিষ্ট্রি পড়েছিস? তোকে দেখে মনে হয় খুব ব্রাইট, আমার হোমওয়ার্ক করে দিবি?” কুণাল উত্তরে বললেন, “করে দেবো না, তবে সাহায্য করতে পারি।” পরে শুনলেন কুণালকে পান্তুয়া খাইয়ে কাজ উদ্ধার করার প্ল্যান। এদিকে কুণাল কিছুতেই তার কোর্সের হোমওয়ার্ক করে দেবে না। পুরো হোমওয়ার্ক করে দেবার মধ্যে যে নৈতিক সমস্যা থাকতে পারে, এটা সুস্মিতার বরের মাথায় আসতো না। অগত্যা বাড়ীতে নেমন্তন্ন করতে শুরু করলেন। বলে দিলেন “আমাকে পড়াবি, রাতে খেয়ে যাবি।” প্রথমদিন কুণাল তাদের বাড়ী এসেছেন রাতের খাওয়া খাবেন বলে, দেখলেন মাংসের ঝোলের মধ্যে চারটে ড্রামস্টিক আর একটা ডানা। তিনজনের খাবার। কুণালের খুব ভালো লেগেছে। মাংস নিজেই নিলেন তার প্লেটে, সেই ডানার মাংস। বর বললেন, “কিরে ওটা নিলি কেন? তোর জন্য ড্রামস্টিকস্।” কুণাল শুনলেন ডানাটা সুস্মিতা খাবে। সহজ সরল মানুষ, জিজ্ঞেস করলেন, “ওর বুঝি খুব ডানা খেতে ভালো লাগে?” সুস্মিতা উত্তর দিলেন, “হ্যাঁ আমার খুব ভালো লাগে।” আবার আরেকদিন এসেছেন কুণাল তাদের বাড়ীতে পড়াতে। খেতে বসে বলেই ফেললেন “আমি কি তোর ডানাটা খেতে পারি?” বর উত্তর দিলেন “ডানার দাম কম, ওটা খাস না। ড্রামস্টিকস্ খা।” এরকম অনেক ব্যাবহারের মধ্য দিয়ে সুস্মিতার কাছে তার বরের মানসিকতা ক্রমশঃ প্রকট হতে থাকে।
একদিন সুস্মিতার খুব জ্বর হয়েছে। শুনে এক পরিচিতা বাংলাদেশী বৌদি, দাদাকে পাঠালেন ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবার জন্য। তাতে বরের তো ভীষণ রাগ। কিন্তু কিছু করার নেই। যেতেই হল। ডাক্তার অ্যান্টিবায়োটিক প্রেস্ক্রিপশন লিখে দিলেন, প্রচুর জুস খেতে বললেন। এদিকে ওষুধ কেনা হয়নি। কুণাল ফোন করে সব শুনে তার ছাত্রকে ওষুধ আনা হল কিনা জিজ্ঞেস করাতে উত্তর “তোর মাথা খারাপ! এই ১৪ ইঞ্চি বরফ ভেঙ্গে ওষুধ এনে দেব! জানিস না মেয়েমানুষের নয় জন্ম? এরা মরে না।” কুণাল তখন বরের অনুমতি নিয়ে সুস্মিতার জন্য ওষুধ ও তিন কার্টন জুস এনে দিলেন। পরেরদিন ফোন করে জিজ্ঞেস করে জানলেন যে পাছে তার নিজের জ্বর হয়, সেই ভয়ে বর সব জুস খেয়ে ফেলেছে। অবাক হয়ে বলেই ফেললেন, “আমি কি কানে ঠিক শুনছি? ওর হবে বলে সব জুস খেয়ে ফেলেছে? কি জানি, আমি তোদের ব্যাপারস্যাপার কিছু বুঝি না!”
যাই হোক, কুণালের পড়ানো ব্যার্থ করে রেজাল্ট ভাল না করায় অ্যাসিস্ট্যান্টশিপ নাকচ হয়ে গেল সুস্মিতার বরের। আবার ক্যানাডার আরেক শহরে কেমিস্ট্রি ডিপার্ট্মেন্টে ফিরে গেলেন সুস্মিতাকে নিয়ে। ইচ্ছা এখানে পি এইচ ডি করবেন। এবারে বাসা এক পাঞ্জাবী বৃদ্ধ-বৃদ্ধার বাড়ীতে। আরো দু-একজনের সঙ্গে আলাপ হল। এদের মধ্যে এক দম্পতি বাংলাদেশের এক ভাই আর ভাবী। একদিন শুয়ে আছেন, ধূম জ্বর। সেদিন তাদের দুজনের নেমন্তন্ন। বাড়ী ফিরে এসে সুস্মিতাকে শুয়ে থাকতে দেখে ঠিক করলেন তিনিও যাবেন না। জিজ্ঞেস করলেন, “কি রান্না করেছ?” সুস্মিতা উত্তরে বললেন “গতকালের তরকারী আছে। রান্না করতে পারিনি।” বর শুনেই প্রচন্ড রেগে সুস্মিতাকে টানতে টানতে উপরে তুলে দরজা দিয়ে বার করে দিলেন। দোষ? টাটকা রান্না নেই কেন?এদিকে ঘটনা দেখে সেই পাঞ্জাবী ভদ্রলোক চিৎকার করে উঠলেন এবং পুলিশ ডাকবেন বলতে লাগলেন। তাতে তার গলা টিপে ধরে আরো কুৎসিত কদর্য ভাষায় সুস্মিতাকে আক্রমন করলেন। এদিকে বাইরে ঠান্ডায় সুস্মিতার নাক-মুখ, শরীর জমতে শুরু করেছে। মনে হল কি দরকার তার বেঁচে থেকে? অসহ্য অপমান! কিন্তু তারপরেই তার জগত যেন আলোকিত হয়ে গেল। ভাবলেন মরার জন্যে তো তার জন্ম হয় নি। নিশ্চয়ই কোন উদ্দেশ্য আছে তার বেঁচে থাকার।কোথা থেকে এক অদ্ভুত দৃঢ়তা, অপরিসীম শক্তি এল মনে। সিদ্ধান্ত নিলেন কিছু একটা করতে হবে এবং এই অপমান থেকে তাকে বেরোতেই হবে।
এর পরে তারা এক স্টুডেন্ট অ্যাপার্টমেন্টে জায়গা পেলেন। একদিন বর তাকে ফোন করে একটা বই দিয়ে যেতে বললেন স্কুলে। যেতে হবে বাসে কিন্তু তার সঙ্গে তো যথারীতি কোনো পয়সা নেই। নির্দেশ হল সেই বন্ধুভাবীর কাছ থেকে টাকা নিয়ে নিতে। সুস্মিতা পারবেন না বলায় উত্তর “এক পয়সাও তো আয় করতে পারো না, যত ঢং! তুমি তো কিছু করবা না। বেবীসিট করে পয়সা উপার্জন করতে পারো না! আমি ভাবীকে ফোন করে দিচ্ছি। তুমি ৫ ডলার নিয়ে আস।” এখানে বলে রাখি এফ ২ ভিসাতে কিন্তু কোন কাজই করা যেত না তখন, ছাত্র হওয়া ছাড়া।
ভাবী দেখা হতে বললেন, “এক কাপ চা খেয়ে যান। আপনাকে পাঁচ ডলার দেব। আপনার কাছে বড় বড় নোট। খুচরা নোট নাই।” বোঝা গেল ওই ভাবেই মিথ্যা বলা হয়েছে ভাবীকে। ভাবী চা খেতে দিলেন। বললেন, “আপনার সাথে কথা আছে।”
চা দিয়ে, পাশে বসে বললেন ভাবী “আচ্ছা বৌদি আপনি সত্যিই কি ডেন্টিষ্ট? আমার না সন্দেহ লাগে! আর আপনার মা-বাবা-ভাই-বোন নাই?”
সুস্মিতা বললেন “কেন বলছেন?”
ভাবী বললেন, “আমার দিকে তাকায়ে দেখেন। স্কুল ফাইনাল পাশ করি নাই। আপনার ভাই পি এইচ ডি করছে। আমি যদি বলি বাঁ দিকে হেল, বাঁদিকে হেলে, ডানদিকে বললে ডানদিকে হেলে। কি অত্যাচার আপনি সহ্য করেন! নিজের বাড়ীতে ফোন করে তো জানাবেন! আমারে তো বলবেন! বৌদি আমি দুঃখে মরে যাচ্ছি। ভাবছি, কি রকম বাবা-মা! তারা তো ভাববেন আপনার কথা! আমি আর আপনার ভাই আলোচনা করেছি। আমি আপনাকে সবরকম সাহায্য করবো, আপনি পালান এখান থেকে। আমার ইচ্ছা করে লাঠি দিয়া ওনার দুইটা পা ভাঙ্গি।”
সব শুনে সুস্মিতার বুকের মধ্যে তোলপার হতে লাগল। এতদিনের জমে থাকা কান্না, অভিমান, অপমান, বেদনা সব যেন মনের বন্ধ আগল ভেঙ্গে বেরিয়ে এল, তাকে আর আটকে রাখার সাধ্য তার ছিল না। কোনরকমে বাসে করে গিয়ে বই দিয়ে আবার কাঁদতে কাঁদতে বাড়ী ফিরে এলেন। আবার এটাও মনে হল যে একজন তাহলে জানে তার কষ্টের কথা।
বর বাড়ীতে এসে পাঁচ টাকার খুচরো নিয়ে গুনতে গুনতে বলল, “কি আমার সাথে চালাকি হচ্ছে? একটা কোয়ার্টার কম কেন?” তারপরেই সেই চিৎকার! “তুই আমার পকেট থেকে টাকা চুরি করিস। কাকে পাঠাস টাকা? মা-বাবা তো খবর রাখে না।”
এরপর একদিন কুণাল ফোন করতে তিনি সব খুলে বললেন। শুনে কুণাল স্তব্ধ হয়ে রইলেন কিছুক্ষন। তারপর বললেন, “তুই এটা ঠিক করছিস না। তোর ওপর অত্যাচার করে যাচ্ছে, তুই সহ্য করছিস?”
সুস্মিতা বললেন, “আমি কি করে কি করবো বুঝতে পারছি না।”
কুণাল বললেন, “তুই ভাব কি করবি? ভেবে আমাকে জানাস।”
সাহায্যের হাত বাড়ালে, কুণাল তাকে তার বাবার সঙ্গে কথা বলিয়ে দিলেন। বাবা সব শুনলেন। তারা ভেবেছিলেন মেয়ে আমেরিকা এসে তাদের ভুলে গেছে। বাবা বললেন, “তোমার আমাকে আগে বলা উচিত ছিল। তুমি এক্ষুনি বাড়ী চলে এস।” কুণালকে টিকিট কেটে দিতে অনুরোধ করলেন।
সুস্মিতা জানালেন যে তিনি দেড়মাস বাদে বরের কম্প্রিহেন্সিভ (Comprehensive Exam, এটা পাশ না করলে পি এইচ ডি করতে পারবে না) পরীক্ষা করিয়ে দিয়ে তিনি যাবেন। এই সুবাদে অনেক কিছু জানতে পারা Yellow page দেখে সাহায্য পাবার সব খবরাখবর পাওয়া গেল। সেই প্রথম “Battered Women Center” সম্বন্ধে জানা হলো। এর মধ্যে গায়ে হাত তুললে “Battered Women Center”-এ যে যাওয়া যায় তাও জানা গেল।
একদিন সময় করে বরকে জানিয়ে দিলেন যে তিনি চলে যাবেন। বরের কোন প্রতিক্রিয়া হল না। এইখানেই লোকটা হেরে গেল! ভাবে নি যে মেয়েদের যেমন নটা জন্ম থাকে, তাদের শক্তিও থাকে অপরিসীম! টিকিটের ব্যাবস্থা হয়ে গেল। এর মধ্যে বাড়ীতে সবকিছু গুছিয়ে রেখে, শ্বশুরবাড়ী থেকে পাওয়া গয়না রেখে চলে যাবার জন্য তৈরী হলেন সুস্মিতা। এরপর সেই বিস্ফোরনের সময় এল। জানালেন যে তিনি দেশে ফিরে যাচ্ছেন। তার সব ব্যার্থতার রাগ ঝরে পড়ল সুস্মিতার ওপরে। শুরু হল কদর্য চিৎকার – “তুই আমাকে ছেড়ে যাবি? তোর তো শুধু দেহ বিক্রি করতে হবে। আর কিছু তো করার ক্ষমতা তোর নেই। দেখবো কি করে পালাস……… ইত্যাদি ইত্যাদি।”
উত্তরে সুস্মিতা বললেন, “যেখানে সন্মান নেই, সেখানে আমি নেই। আর, আমি কি করব তা তোমাকে ভাবতে হবে না।”
“তোকে এখানেই ডিভোর্স দেব।”
“হ্যাঁ দিতে পার, তবে তোমাকেই সব খরচা দিতে হবে।”
শুনে তো লোকটা শিউরে উঠলো! “যা যা বাড়ী যা। ভাই-বৌ লাথি মেরে বার করে দেবে।”
যাবার আগেরদিন কুণাল তার সহপাঠী দীপাকে পাঠালেন সুস্মিতার কাছে। সে সুস্মিতাকে প্লেনে তুলে দেবে। দীপা এসেই সাবধান করে দিল লোকটাকে। সে যেন যাবার সময় কোনো রকম ঝামেলা না করে। তাকে পরিস্কার বলে দিল যে ঝামেলা করলেই পুলিশ ডাকা হবে এবং তাতে ছাত্র ভিসা নাকচ হয়ে যাবে। এই একটি কথায় সে একদম চুপ করে রইল।
দেশে ফিরে এলেন বিকেলবেলা। বাবাকে একদিন সবকিছু খুলে বললেন, সারা রাত ধরে। কথা শেষ হতে চায় না। অনেকদিনের না বলা কথা যেন বাঁধ ভেঙ্গে বেরিয়ে আসতে থাকে হু হু করে। সব শুনে বাবার প্রেশার বেড়ে যায়। বাবা ভাবতে পারেন না তাঁর ছোট্ট আদরের মেয়ের এত কষ্ট পাবার কথা! এক সপ্তাহ লেগেছিল সুস্থ হতে। চিঠি লিখলেন জামাইকে। “আমায় খুলে বল কি হয়েছে। আমিও তোমার কথা শুনতে চাই।” দীর্ঘ একমাস পরে উত্তর এলো। তাতে লেখা যে এবারের ভাড়ার টাকা ও আর দিতে পারবে না। বাবাকে দিতে হবে। বাবা সেইদিনই এক বন্ধু উকিলের কাছে গেলেন এবং তারপর ডিভোর্সের মামলা করা হল।
সুস্মিতা আবার বাবা-মায়ের কাছে থেকে আগের জীবণে ফিরতে চেষ্টা করলেন। কিন্তু কোথায় যেন একটা অদৃশ্য স্ট্যাম্প মারা হয়ে গেছে তার ওপর ডিভোর্সী মেয়ে বলে। সবার ভেতরে একটা চাপা যন্ত্রনা। মা ভেঙ্গে পড়লেন। ক্রমশঃ মনে হতে লাগল তিনি আর এখানে আগের মতো থাকতে পারবেন না। তার ফিরে আসার আগে কুণাল তাকে বলেছিলেন যে তিনি সুস্মিতাকে ভালোবাসেন। এ নিয়ে ভাববার তার অত সময় ছিল না তখন। এদিনে বাবা ফোন পেতে লাগলেন কুণালের কাছ থেকে। বাবাকে চিঠি লিখে বিয়ের প্রস্তাবও দিয়েছেন। তাদের বাড়ী থেকে এক এক করে সবার চিঠি আসতে লাগলো বিয়ের কথা জনিয়ে। সেই বিষয় নিয়ে বাবা-মা কিছুদিন ভাবলেন, তারপর বিয়েতে সন্মতি দিলেন। ১৯৮৪ সালে বিয়ে হল দুজনের কলকাতায়। সুস্মিতার জীবণের এক পর্ব শেষ হল।আরেক পর্বের শুরু হল।
প্রশ্ন জাগে মনে যে এত দিন সহ্য করেছিলেন কেন? ভেবেছিলেন মানিয়ে নেবেন। সবার সংসারেই তো কিছু না কিছু থাকে খুঁত থাকে। কিন্তু যেখানে মনের ব্যাবধান অনেক বেশী, চিন্তা-ভাবনার অনেক তারতম্য, সেখানে হাজার চেষ্টা করলেও মানানো মুশকিল। এছাড়াও যে কোনো মানুষের চরিত্র তৈরী হয় তার বড় হবার পরিবেশ থেকে। এখানেও দুজনের বড় হবার মধ্যে অনেক ফারাক। যে সময়ের কথা বললাম, সেই সময়ে মোবাইল ফোন ছিল না, টেক্সট (Text) করা বা ওয়াট্স এপ (Whats App) ইত্যাদির কথা ছেড়েই দিলাম। কাজেই তিনি কাউকেই বলতে পারেন নি যে তিনি বাড়ীতে জানাতে চান, কারণ সেটা বলতে গেলে তো তার বরের নামেই বলতে হবে। সুস্মিতা এখনো খুব ভাবেন সেই সব মেয়েদের কথা যারা স্বামীর স্টুডেন্ট ভিসায় তার ওপর সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করে বিদেশে যান এবং অত্যাচারিত হন। কারণ তিনি নিজেই তো ভুক্তভোগী।