সহচরী ১১/ মন্দাক্রান্তা বসু

সহচরী ১১/ মন্দাক্রান্তা বসু

Image

এবার আমার সহচরী হলেন একজন সংস্কৃতজ্ঞ পন্ডিত, প্রফেসর এমেরিটাস ইউনিভার্সিটি অফ ব্রিটিশ কলম্বিয়া, সেন্টার অফ ইন্ডিয়া এন্ড সাউথ এসিয়ান রিসার্চ -এর প্রাক্তন ডিরেক্টর, এবং অক্সফোর্ড সেন্টার অফ হিন্দু স্টাডিস্‌ এর সিনিয়র ফেলো। এটাই সব নয়। তিনি একজন স্ত্রী, মা এবং ঠাকুমা। এই ভ্যাঙ্কুভারবাসিনী অসীম গুণবতী, বিদুষী মহিলার নাম শ্রীমতী মন্দাক্রান্তা বসু।

মন্দাক্রান্তার জন্ম বিহারের ভাগলপুরে। কলকাতায় আসেন চার বছর বয়সে। বাবা ছিলেন ইতিহাসের অধ্যাপক। মার স্কুল ছিল। তারা পাঁচবোন। অল্পবয়সে বড়দিদি ও মেজদিদি মারা যান। ছোট্ট মন্দাক্রান্তা প্রথমে বেথুনে পড়াশুনা শুরু করেন এবং স্কুল শেষ করেন ভবানীপুরের বেলতলা গার্লসে।।আরম্ভ হল কলেজ জীবন। প্রথমে আই এ পাশ করলেন লেডী ব্রাবোর্ণ কলেজ থেকে, বি এ প্রেসিডেন্সী কলেজে (ও সংস্কৃত কলেজে) এবং সবশেষে কলকাতা ইউনিভার্সিটিতে সংস্কৃতে এম এ স্মৃতি ও মীমাংসা নিয়ে। এরপর চাকরী জীবন শুরু হল। বিয়েও হয়েছে ততদিনে।

স্বামী-স্ত্রী দুজনেই পড়াতে শুরু করলেন। স্বামী পড়াতেন ইংলিশ প্রেসিডেন্সী কলেজে আর তিনি পড়াতেন সংস্কৃত সিটি কলেজ নর্থে।ইতিমধ্যে অক্সফোর্ডে আরো পড়াশুনা করার সু্যোগ এল এবং তিনি স্বামীর সঙ্গে পাড়ি দিলেন ইংল্যান্ডে।এরপর সুপারভাইসারের উৎসাহে নাট্যশাস্ত্র পড়তে শুরু করলেন। যত শাস্ত্র আছে এই বিষয়ে পড়ে ফেললেন। এরপর পড়াশুনা শেষ হলে দুজনেই দেশে ফিরে যান। স্বামী বর্ধমান ইউনিভার্সিটিতে শুরু করেন অধ্যাপনা। মন্দাক্রান্তা তখন ইউ জি সি-র ফেলোশিপ নিয়ে ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটিতে ভারতের ধ্রপদী নৃত্য ও নাট্য বিষয়ে রিসার্চ করতে শুরু করেন।উদয়পুরে কিছুদিন ছিলেন কর্মসুত্রে। বছরদশেক দেশে কাটিয়ে ১৯৭৪ সালে ভ্যাঙ্কুভারে ইউনিভার্সিটি অফ ব্রিটিশ কলম্বিয়ায় ডক্টরেট শুরু করেন তার স্বামী। মন্দাক্রান্তাও কম্‌প্যারেটিভ লিটারেচারে মাষ্টার্স করলেন। চার বছর বাদে পড়াশুনা শেষ করে দেশে ফিরে গেলেও আবার দেশের মায়া কাটিয়ে একেবারে ভ্যাঙ্কুভারে সেটেল্‌ করেন এই পরিবারটি।

এরপর ৪৫ বছর ক্যানাডার ভ্যাঙ্কুভারে। দুজনেই অধ্যাপনা করেছেন। তাদের এক মেয়ে, এক ছেলে। মেয়ে যখন কলেজে আর ছেলে স্কুলে, মন্দাক্রান্তা পাড়ি দিলেন অক্সফোর্ডে ডক্টরেট করতে। দৈনিক ১৮ ঘন্টা কাজ করে ডক্টরেট শেষ করেন ১৯৮৯ একবছরে। কি অসামান্য অধ্যাবসায় আর দৃঢ়তা! এইসময়ে তার স্বামী ছেলের দেখাশুনা করেছেন।

মন্দাক্রান্তার দীর্ঘ অধ্যাপনার জীবন তিনি রিসার্চ করে অনেক বই  লিখেছেন।  Gender and religion in Hinduism, Buddhism, Dance Text ইত্যাদি বহু বিষয়ে। তবে তার প্রধান কাজ হল সংস্কৃত জগতে দ্বিতীয় থেকে অষ্টাদশ শতাব্দী নাচ, নাটক ও সঙ্গীতের অভিযোজন ও বিবর্তন নিয়ে। অনেক ক্ষেত্রেই মালমসলা যোগাড় করা কষ্টসাধ্য। রিসার্চের জন্য অনেক সময়ে ভারতের বিভিন্ন জায়গায় যেতে হয়েছে। কিন্তু তাতে থেমে থাকেন নি মন্দাক্রান্তা।হারিয়ে যাওয়া পুঁথি যোগাড় করতে বিভিন্ন শহরের (বেনারস, জন্মু, জয়পুর, কেরালা, চেন্নাই) বিভিন্ন লাইব্রেরী ঘুরেছেন, পুনর্গঠন (reconstruct)করেছেন, প্রকাশ করেছেন। নারী ও ধর্মের ওপর অনেক কাজ করেছেন।রামায়ণের বিভিন্ন রূপ আছে, একেকটি রামায়্ণ একেক রকম।এই সব নিয়ে তার রামায়ণের ওপর সম্পাদিত বই রামায়ণ রিভিসিটেড (Ramayan revisited)। এছাড়াও রামায়ণের ওপর পটচিত্র (Scroll)নিয়ে বই লিখেছেন ২০১৭ সালে। বর্তমানে ষোড়শ শতাব্দীতে মহিলা কবি চন্দ্রাবতীর লেখা রামায়ণ, সীতার জবানীতে, এই বইটি অনুবাদ করছেন মেয়ের সঙ্গে।

Book 1 imageBook 2

অধ্যাপনা ও বই লেখা জন্য তিনি সরকারী ও বিভিন্ন সংস্থা থেকে রিসার্চ গ্রান্ট (যেমন, Social Sciences and Research Council of Canada) পেয়েছেন।এখনো প্রতিবছর দুমাস থাকেন অক্সফোর্ডে গবেষণা ও বক্তৃতার জন্য, এপ্রিল থেকে জুন। এরই ভিত্তিতে বর্তমানে দুটি বই লিখছেন।

এবারে মন্দাক্রান্তার আরেকটি অনবদ্য গুণের কথা বলব। ছোটবেলায় মণিপুরী ও কথাকলি শিখেছেন। জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ীতে শ্রীমতী ঠাকুর ও মঞ্জুশ্রী চাকী সরকারের কাছে নাচ শিখেছেন দশ বছর। কাজেই তিনি যে খুবই ভালো নাচেন সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। যখন ভ্যাঙ্কুভারে প্রথম আসেন, ওখানে নৃত্যশিক্ষার্থীদের নাচ শেখার কোনো সুযোগ ছিল না। উনি এক ভারতনাট্যম শিল্পীকে দিয়ে নাচ শেখার সুযোগ করে দেন অনেকের।

Book 4

এখনো দুর্গা পূজোয় প্রতিদিন পুজোমন্ডপে চন্ডীপাঠ করেন। কলেজের বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ আছে। তাদের সাত বন্ধুর একটা দল আছে।তাদের সঙ্গে দেখা করেন প্রতিবছর যখন কলকাতায় যান। জানুয়ারী -ফেব্রুয়ারী দুমাস দেশে কাটান, তারপর গ্রীষ্মকালে অক্সফোর্ডে চলে যান স্বামী-স্ত্রী।মেয়ে ইউনিভার্সিটি অফ ভ্যাঙ্কুভারে ইংলিশে অধ্যাপনা করে।কাছেই থাকে।ছেলে থাকে ভারমন্টে, জিওগ্রাফিতে অধ্যাপনা করে। বছরে দুবার যান ওদের কাছে, নাতনীর সঙ্গে সময় কাটান।

মন্দাক্রান্তাদিকে দেখার ও তার কথা শোনার সু্যোগ হয়েছিল এইবছর বংগসন্মেলনে বাল্টিমোরে। সাহিত্য সেমিনারে এসেছিলেন নিমন্ত্রিত বক্তা হিসেবে। খুব অনুপ্রাণিত হয়েছিলাম। ভীষণ মার্জিত, ধীর-স্থির, স্বল্প-বাক এই মানুষটিকে দেখলে বোঝা যায় না যে তিনি এত গুণের অধিকারিনী। আরো রিসার্চ করুন, আরো বই লিখুন, সুস্থ থাকুন এবং আমার মতো অনেক প্রবাসী বাঙ্গালী মেয়েদের উদ্বুদ্ধ করুন এই কামনা করি।

 

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান